ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠন করতে হবে
মিশরে আল আজহারের ঐতিহাসিক ভাষনে যা বলছেন ড. ইউনুস ! (প্রথম বাংলা অনুবাদ)
আপলোড সময় :
০৭-০১-২০২৫ ০২:০৬:৩৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৭-০১-২০২৫ ০২:৫৩:৪৫ অপরাহ্ন
ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনের আহ্বান:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস মিশরের রাজধানী কায়রোতে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত সুপ্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ভাষণ দিয়েছেন। ১৯ ডিসেম্বর কায়রোর আল-আজহার ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হলে ভাষণ দেন তিনি। যেখানে উপস্থিত ছিলেন আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. সালামা দাউদ, উপ-উপাচার্য ড. মাহমুদ সিদ্দিক, বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের এক বিশাল অংশ।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার ভাষণটি নিইউজ ইউ টুয়েন্টিফোর এর সম্পাদনা বিভাগ থেকে অনুবাদ করে বাংলাভাষী পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো;
ড. ইউনুস আল আজহারের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা এবং এই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাথে থাকার আনন্দ প্রকাশ করে বলেন,আল আজহারের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে আসা আমার জন্য বিশাল সম্মানের। আমি যতবারই মিশরে আসি, দূর থেকে আল আজহারের দিকে তাকাই। আজ এখানে এসে কথা বলার সুযোগ পাওয়া আমার জীবনের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
আল আজহারের বিশাল শিক্ষার্থীবহর এবং এর বিশ্বব্যাপী ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা যারা এখানে পড়ছেন, তাদের জন্য এটি একটি বিরল সুযোগ। এখানকার শিক্ষা আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করবে এবং আপনাদের মানবতার বৃহত্তর কল্যাণে অবদান রাখতে সাহায্য করবে।
ড. ইউনুস তাঁর শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন,আমার বাবা আমাদের বলতেন যে আল আজহার শুধুমাত্র প্রাচ্যের একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; বরং এটি বিশ্বময় জ্ঞানচর্চার একটি বিশ্বস্ত কেন্দ্র। অতীতকাল থেকে আমাদের অঞ্চল থেকে শত শত শিক্ষার্থীরা এই প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান অর্জনের জন্য এসেছেন।
তিনি আরও বলেন, আল আজহার ইসলামের মূল শিক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। এটি আলোকবর্তিকা, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি, সহনশীলতা এবং অন্তর্ভুক্তির এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবতার জন্য প্রাসঙ্গিক।
ড. ইউনুস আল আজহারকে একটি মেলবন্ধন হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এটি বিভিন্ন ইসলামী মতাদর্শের মিলনস্থল। এখানে হানাফি, মালিকি, শাফি এবং হাম্বলি মতবাদসহ ইসলামে স্বীকৃত বিভিন্ন ধারার চিন্তাধারা সমানভাবে সমাদৃত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে মূল্যবোধ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল, আল আজহার এখনও তা ধারণ করে আছে।
তিনি আরও বলেন, আল আজহার শুধু ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বিজ্ঞান এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রেও মানুষের মধ্যে অনুসন্ধিৎসার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে।
বাংলাদেশে আল আজহারের প্রভাব:
বাংলাদেশে আল আজহারের প্রভাব উল্লেখ করে ড. ইউনুস বলেন, আল আযহারের প্রভাব বাংলাদেশের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী। এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েট বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশে সুফিবাদ প্রসার ঘটিয়েছেন, যা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। আজও আল আযহারের পণ্ডিতদের মতামত আমাদের দেশে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচিত হয় এবং এটি আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দারিদ্র্য বিমোচনে তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান:
ড. ইউনুস তাঁর বক্তব্যে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের আওতায় কীভাবে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আপন দেশে টেকসই মানবিক সাহায্যের ব্যবস্থা করতে গিয়ে উল্লেখ করে বলেন, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধুমাত্র বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং নতুন সমাধানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্যে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, দারিদ্রতা বিমোচন ও মানুষকে সাহায্য করার এ মহান দায়িত্ব তরুণদেরই বহন করতে হবে।
ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনের আহ্বান:
ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনের গুরুত্ব তুলে ধরে ড. ইউনুস বলেন, ইসলামের মূল্যবোধ ও নীতির আলোকে এই পৃথিবীতে আমাদের একটি নতুন অবস্থান গ্রহণের সময় এসেছে। বিশ্ববাসীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সম্প্রীতি বজায় রেখে আমাদের আবারও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। আমি আশা করি, আল আযহার আমাদের সমাজে সেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেবে। এই প্রতিষ্ঠানের জ্ঞান বিজ্ঞান, নৈতিকতার এবং আধ্যাত্মিকতার সর্বজনীন বার্তা শুধু বিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরই নয়, বরং সমগ্র মানবতাকেই একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুসংগঠিত সভ্যতা গ্রহণে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি, যখন মানব প্রচেষ্টা অবশ্যই ন্যায়বিচার, অংশগ্রহণ মূলক একটি ন্যায়সঙ্গত বৈশ্বিক ব্যবস্থার সন্ধানের দিকে নিবদ্ধ হতে হবে। এই ব্যবস্থা মানবিক সহানুভূতির চেতনা সর্বাগ্রে রাখবে, যেখানে প্রতিশোধ, অবিচার এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কোনো স্থান থাকবে না।
গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞের প্রসঙ্গে ড. ইউনুস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গত ১৪ মাসে ৪৫,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার একটি নির্মম উদাহরণ। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি ন্যায়সংগত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ আহ্বান:
ড. ইউনুসের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ঐতিহাসিক বক্তৃতায় ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ প্রসঙ্গও গুরুত্বসহকারে উঠে এসেছে। ইসলামী বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণের ওপর জোর দিয়ে বলেন, আমাদের শিক্ষাবিদ এবং গবেষকদেরকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং বিশ্বজুড়ে জ্ঞানচর্চার সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা অপরিহার্য।
আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ এবং টেকসই বিশ্ব গড়তে একসাথে কাজ করতে হবে বলে গভীর আহ্বানের মাধ্যমে দিয়ে ড. ইউনুস তাঁর ঐতিহাসিক এই বক্তৃতা শেষ করেন।
মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) সকালে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর রিটজ কার্লটন হোটেলে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম এ মন্তব্য করেন।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী। আপনি একজন বিচক্ষণ মানুষ। আহমেদ এলতায়েব বলেন, বিপ্লবের পর দেশ একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।
‘আমি আপনাকে আপনার বিচক্ষণতার জন্য স্যালুট জানাই’, বলেন তিনি ।
অধ্যাপক ইউনূস আমন্ত্রণ জানানোর জন্য গ্র্যান্ড ইমামকে ধন্যবাদ জানান। তিনি গ্র্যান্ড ইমামকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের ফলে যে গভীর পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছিল তা নিজের চোখে দেখার জন্য।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা গণ-অভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে ইমামের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্ব, তার সামাজিক সেবা, ক্ষুদ্র ঋণদাতা হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের অগ্রণী ভূমিকা এবং দারিদ্র্য মোকাবিলায় তার আজীবন প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস আল-আজহারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন তিনি গ্রামীণ ব্যাংক চালু করেন, তখন শীর্ষ সুন্নি ইসলামিক প্রতিষ্ঠান আদেশ দেয় যে সুদ ব্যবস্থা ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
প্রধান উপদেষ্টা আর্ট অব ট্রায়াম্ফের একটি অনুলিপি, বিপ্লবের সময় আঁকা দেয়ালের ম্যুরাল এবং গ্রাফিতিতে বিখ্যাত আর্ট বই গ্র্যান্ড ইমামের কাছে হস্তান্তর করেন।
গ্র্যান্ড ইমাম বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের শৈল্পিক দক্ষতার প্রশংসা করেন। তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদেরও প্রশংসা করেন।
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় তিনি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করায় বাংলাদেশের জনগণ আজ ব্যাংক থেকে সুফল ভোগ করছে।
তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাকে স্বপ্ন দেখতে হবে, যদি আপনার স্বপ্ন না থাকে তবে আপনি জীবনে সফল হবেন না।’ প্রফেসর ইউনূস বলেন, তার স্বপ্ন ছিলো বলেই গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। সামাজিক ব্যবসার গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সমাজ পরিবর্তনে লক্ষ্য অর্জনে সামাজিক ব্যবসার বিকল্প নেই। তার ‘থ্রি জিরো থিওরি’ সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী বলেন, বিশ্বকে এগিয়ে নিতে শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য দারিদ্র্য এবং শূন্য বেকারত্ব- এই তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : NewsUPload
কমেন্ট বক্স